পাপ স্বীকার
লেখক : জান্নাতি বেগম
বেশ কয়েক বছর আগেই পৃথিবীর সকল জ্ঞানী ও ধনী মানুষ মঙ্গলে বাসা বেঁধেছে সেখানে লবণাক্ত পানি পাণ ,সেখানকার বৃক্ষের লবণাক্ত ফল খেতে সকলেই অভ্যস্ত হয়েছে । পৃথিবীর প্রায় সকল ফলমূলের উৎপাদন সেখানে করা হচ্ছে কিন্তু সাধের তফাৎ টা শুধু তারায় বুঝবেন যারা গাছ পাকা আম খেয়েছেন এবং টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখে মুগ্ধ হয়ে পাকা আমের বিশুদ্ধ আর্সেনিক মুক্ত জুস পান করেছেন ।আরও বুঝবেন যারা রাজশাহীর পাকা আম ও সিলেটের পাকা আম খেয়েছেন ।শুধু আম নয় সকল ফলমূলের অধিক উৎপাদন,গুনগত মান নিয়ন্ত্রন পৃথিবীর বুকেই সম্ভব হয়ে উঠেনা তো মঙ্গল গ্রহে কি ভাবে হবে ?পৃথিবীর প্রায় সকল উন্নয়ন শীল ও দরিদ্র দেশগুলর জন সাধারনের কিছু পুরনো রোগ আছে কিছুদিন আগে বি ডি গোল্ড এর একটি জরিপে ধারণা করা হয় এই রোগের প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে ৩০০ মিলিয়ন গবেষক , ডাক্তার প্রান হারিয়েছেন সেই রোগ গুলোর একটি হল দৌড় দিয়ে ঝগড়া , মিছিল ,রিলিফ নিতে ,নেতা নেত্রীদের ছাতা ধরতে , নতুন বৌ দেখতে যাওয়া ইত্যাদি ।
আরও রোগ আছে সেগুল এমন সবলের পদতলে দুর্বল ,একটু লাঞ্চ টাইম বেশী নেবার জন্য শ্রমিকদের মুখে লাথ মারছে মালিক পক্ষ ,পেটের ক্ষুধা নেয় তবু মনের ক্ষুধা মেটাতে সাধারন জনতার সাথে বেইমানি করছে অধিকাংশ নেতা নেত্রীর দল ।আজ মানুষের নানান পদের ক্ষুধা দেখে পৃথিবীর সকল প্রাণীর ক্ষুধা হারিয়ে যাচ্ছে ।
মঙ্গল গ্রহ থেকে ফিরে আসা জুতা চোর আব্দুলকে দেখতে গ্রামের সকল মানুষ ছুটে যাচ্ছে সাথে নিয়ে এসেছে মঙ্গলে ভুমিস্ট হওয়া সন্তান সুসন । এই সুসন দেখতে কেমন হবে সার্কাসের সং এর মত নাকি অন্য রকম বাংলাভাষায় কথা বলবে নাকি অন্য ভাষায় ,মঙ্গল থেকে কিছু খাবার ও নিয়ে আস্তে পারে সকলের জন্য ছুঁড়ে দিতে পারে সে ।
হেলিকপ্টর থেকে যে ভাবে ত্রান ছুঁড়ে ফেলা হয় সেই ত্রান টুকু কুড়িয়ে নিতে গিয়ে মানুষের পদতলে মৃত্যু হয় অবুঝ শিশু বা বিদ্ধ বিদ্ধার ।রক্তাত অঙ্গে মৃত্যুর তীরে নঙ্গুর ফেলেও ক্ষুধার্ত মৃত্যু পথ যাত্রী বলে আমাকে একটু খেতে দাও আমি যে খুব ক্ষুধার্ত তোমরা আমকে এক মুঠ ভাত দাও তোমাদের মুঠো মুঠো ভাতে আমি পর্বত গড়ব ,একটি মানুষ ও আর এক মুঠ ভাতের জন্য কাঁদবেনা ।সূর্যমাখা রোদে বেড়ে উঠবে বাংলার সোনালি আঁশপাট শান্তির ঝর্নার স্রোতের ভেসে যাবে আছে যত দুঃখ অভিমান ।এই পর্বতের শেষ চূড়াই উড়বে স্বাধীনতার প্রতীক আমার প্রিয় মুক্ত বিহঙ্গ লাল সবুজের পতাকা ।
এই আব্দুল আজ মঙ্গল গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসেছে পাপ স্বীকার করতে এই নগ্ন শতাব্দীতে মানুষ যে ভুল স্বীকার করতে চায় ।কথাটি কেন যেন আমার বিশ্বাস হয়না আমি নিজেই আমার প্রতিচ্ছবি দেখি শতবার দর্পণে কাল একটি দাগ নিয়ে ব্যাথা পায় মনে কিন্তু আত্মার কাল মুখোসটা খুলে ফেলতে একবার ও মন চায়নি আমার ।
বি ডি গোল্ডে লাইভ প্রচারিত হবে তার পাপ স্বীকার । কি ?আপনার ও বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি কম্পিউটারের মনিটরের দিকে দৃষ্টি দিন সে কি বলে শুনুন আমি ঘুমুতে যাব ।লাশের ছবি দেখে ভয় পাবেন না ওরা শহীদ ওরা দেশের জন্য প্রান দিয়েছে ।এই যে জোহরার লাশটি দেখছেন একটি কুকুরে তার মাংস টেনে টেনে খাচ্ছে ওটা কুকুর না মানুষ এই ক্ষুধার্ত কুকুরটা সেই মানুষদের প্রতিকৃতি যারা মানুষ খুন করে কৃত্তিম ক্ষুধা মেটাতে হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের উপর জাতীর উপর ধর্মের উপর ।
এই তো শুরু হয়েছে দেখতে থাকুন বি ডি গোল্ডে মঙ্গল গ্রহথেকে ফিরে আসা পৃথিবী প্রেমী আব্দুলের পাপ স্বীকার ও শুনতে থাকুন তার জীবনের গল্প ।
ভিক্ষুকের অনাথাশ্রম
লেখক : হিমেল মাহমুদ
নাম সাহসী। বয়স দশ এগার। নাম সাহসী হলেও ক্ষুধার সামনে বীরত্ব দেখাবে এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে বা কোন কালে ছিল বলে আমার জানা নেই । ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সাহসী খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। কেউ তার এই ক্ষুধার আর্তনাদ শুনতে পায়না। আবার কেউ শুনতে চায়না। কারো বা শোনবার সময় মিলেনা। এই ভাবে তার অনাহারে কেটে যায় দুইদিন। ক্ষুধার যন্ত্রণা আর সইতে পারছেনা। তার চোখে মুখে আন্ধার। সাহসী আর চলতে পারছেনা। সে বসে পরল রাস্তার পাশে এক গাছতলায়। গ্রাম্য হাটের পথ। শত লোকের আসা যাওয়া। বাজার শেষে বাড়ি ফেরৎ এক পথচারীর হাতে গ্রাম্য হাটের খোলা খাবারের পুটলি দেখে সাহসী তাতে হাঁক মারল। সাহসীর ক্ষুধায় কাতর আর অসহায়ে ভরপুর মলিন মুখটা দেখে পথচারীর ভীষণ মায়া হল। সে একটু বসে তার পুটলি খুলে আধাখানি দিয়ে গেল, আধা নিয়ে চলে গেল। খাবার হাতে পেয়ে সাহসীর আধমরা দেহটাতে প্রাণ ফিরে এলো। সে এবার নড়েচড়ে ভালভাবে বসে সেগুলো খাওয়ার জন্য তার জামার মাঝে হাত ঘষে হাত পরিষ্কার করতেছিল। হঠাৎ কোথা থেকে এক কুকুর এসে পলিথিনে মোড়ানো খাবারের পুটলিটা কামড়ে ধরল। সাথে সাথে সাহসী ও পুটলিটা ধরে ফেলল। এবার কুকুর টানছে কুকুরের দিকে, সাহসী টানছে তার নিজের দিকে। দুজনই নাছোড়বান্দা কেউ ছাড়ছেনা। সাহসী বাম হাতে পুটলিটা ধরে টানছে আর ডান হাতে কুকুরের মাথায় কিল দিচ্ছে থাপ্পড় দিচ্ছে। সাহসীর হাতের মৃদু আঘাতে কুকুরটার যেন কিছুই হচ্ছেনা। দুজনে টানাটানি করতে করতে পুটলিটা মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে দুভাগ হয়ে গেল। কুকুরের ভাগ কুকুর নিয়ে গেল, সাহসীর ভাগ তার হাতে রইল।সাহসী কুকুরটাকে কিছুক্ষণ বকাঝকা করে যখনই খাবার মুখে তুলে দিবে অমনি আট নয় বছর বয়সের একটি ছেলে সাহসীর সামনে দাড়িয়ে তার বাম হতটা সাহসীর দিকে বাড়িয়ে দিল। সে নিঃশব্দে সাহসীর কাছে খাবার চাইছে। ছেলেটিকে দেখে মনে হল সে সাহসীর থেকেও আরো বেশি ক্ষুধার্ত। সাহসী আর খাবার মুখে দিতে পারলনা। সে মুখ থেকে খাবার নামিয়ে ছেলেটিকে বলল \" খাবি ? \" ছেলেটি মুখে কিছু না বলে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো। তখন সাহসী ছেলেটিকে কাছে ডাকল। ছেলেটি সাহসীর কাছে গিয়ে তার সামনে বসল। সাহসী খাবারের পুটলিটা দুজনের সামনে মাটিতে রাখল। দুটি শিশুর দানবের মত ক্ষুধা নিবারণের জন্য এই সামন্য খাবার কিছুইনা। তবুও কিছুটা তো ক্ষুধার উপশম হবে। খাবারের পুটলিটা মাটিতে রেখে সাহসী কিছু মুখে দেওয়ার আগেই ছেলেটি সবগুলো খাবার গাপগুপ করে খেয়ে ফেলল। সাহসী কিছুই মুখে দিতে পারলনা। খাওয়া শেষে ছেলেটি যখন উঠে দাঁড়াল, তখন সাহসী অবাক হয়ে অসহায়ের দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটিও তাকিয়ে রইল সাহসীর দিকে সাহসীর চোখের কোণে অশ্রু ঝড়ে ঝড়ে অবস্থা কিন্তু ঝড়ছেনা। সে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। আর সহ্য হচ্ছেনা। তার কণ্ঠে কোন শব্দ বেরুচ্ছেনা। কানে কোন আওয়াজ প্রবেশ করছেনা। চোখের পাতাগুলো আর মেলে রাখতে পারছেনা। সে আর বসে থকতে পারছেনা। মনে হচ্ছে কে যেন তার ঘার ধরে পিছু টানছে। সাহসী ঢলে পরল মাটিতে। ছেলেটি চলে যাচ্ছিল। সাহসীর এমন অবস্থা দেখে সে বুঝতে পারল যে ক্ষুধার কারণে সাহসীর এই অবস্থা। তখন সে দৌড়ে চলে গেল বাজারে। বাজারে গিয়ে দোকানিদের কাছে হাত পাতলে বেচা কেনার ভিড়ের কারণে দোকানিরা সবাই কেউ ধমক দেয় কেউ গালি দেয় আবার কেউ থাপ্পড় দেয়। কিন্তু কেউ এক টুকরো খাবার দেয়না। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে সে কোন খাবার পেলনা। নিরুপায় হয়ে সে একটি পুরি সিঙ্গারার দোকান থেকে দুটি সিঙ্গারা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সে পালাতে পারলনা। দোকানের মালিক দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলল। অত্যন্ত কর্কশ ভঙ্গিমায় অশ্লীল ভাষায় কয়েকটি গালি দিয়ে ছেলেটির গলা চেপে ধরল। এমন ভাবে ধরল যে ছেলেটির নিঃশ্বাস বেরুচ্ছেনা। ছেলেটি গো গো করতে লাগল। তখন দোকানের মালিক ছেলেটিকে উপরে তুলে ছুড়ে ফেলার মত করে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। এবার সে ছেলেটির হাত থেকে সিঙ্গারা দুটি কেড়ে নিতে চাইছে। কিন্তু ছেলেটি ছাড়ছেনা। তখন লোকটি ছেলেটিকে কিল থাপ্পড় লাথি মেরে মেরে এদিক থেকে ওদিকে নেয়,ওদিক থেকে এদিকে আনে। তবুও ছেলেটি তার হাত থেকে সিঙ্গারা দুটি ফেলছেনা। সে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
একটি ভিক্ষুক বাজারে এসেছে ভিক্ষা করতে। ভিক্ষুকের চোখে পরল এই ঘটনা। সেই ভিক্ষুক এগিয়ে এলো। সে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলো তারপর সিঙ্গারা দুটি মালিক কে ফেরৎ দিল। ছেলেটি মার খেয়ে কাঁদতে পারছেনা সে শুধু ফোঁপাচ্ছে আর ঢেকুর পারছে। ভিক্ষুক ছেলেটিকে বলল \" তুই চুরি করতে গেলি কেন ?\" ছেলেটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বলল \" আমার বইনে পেটের ক্ষুধায় মইরা যাইতাছে \" ভিক্ষুক চমকিত হয়ে বলল \"কোথায় ?\" ছেলেটি তখন ভিক্ষুককে সাহসীর কাছে নিয়ে গেল। ভিক্ষুক সাহসীকে এই অবস্থায় দেখতে পেয়ে তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলনা। সে কেঁদে ফেলল। তারপর সে নিজে নিজে বলল ( হে খোদা গরীবের পেটে তুমি এত ক্ষুধা কেন দিলে ? ) ভিক্ষুক সাহসীকে ধরে সাহসীর মাথাটা তার বাহুতে রেখে তার থলে থেকে একটা পানির বোতল বের করে সাহসীর মুখে একটু পানি ঢেলে দিল। পানি যখন সাহসীর গলার ভিতরে গেল তখন সে চোখ মেলে তাকাল এখনও সাহসীর গায়ে শক্তি ফিরে আসেনি। সাহসী টগবগে চেয়ে আছে ভিক্ষুকের মুখের দিকে। এবার ভিক্ষুক তার থলে থেকে দুটি কলা বেড় করে ছিলে সাহসীকে দিল। সাহসী কলা দুটি খাওয়ার পর কিছুটা ক্ষুধা নিবারণ হল। এবার ভিক্ষুক সাহসীকে কোলে করে আর ছেলেটিকে হাতে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেল। ভিক্ষুকের ছোট কুড়ে ঘর। সাহসী দেখল এখানে আরো কিছু শিশু রয়েছে। ভিক্ষুক সাহসীকে বলল \"এটা এক গরীবের অনাথাশ্রম, আজ থেকে তোরা এখানেই থাকবি। তোরা সবাই আমার সন্তান, এখন থেকে তোরা আর রাস্তা ঘাটে ঠোক্কর খাবিনা, হাতে হাতে মার খাবিনা, আর অনাহারে থাকবিনা /
ভালোবাসার রঙিলা পাখি
লেখক : আফরোজা অদিতি
তোর থাইক্কা বেশী কামাই করি এখন আমি। তুই সাব গো বাড়ির কাম ছাইড়া দে।
শবেবরাতের সারা রাত রিকশা চালিয়ে ঘরে ফিরে চোঙা মুখে ‘স্কুলের মাঠে জনসভা, জনসভায় যোগ দিন, যোগ দিন’ জাতীয় চোঙা ফোকার মতো করে কথাগুলো বলে যায় লাল মিয়া।
লাল মিয়া রিকশা চালায়। লালমিয়ার বউ, লালমতি মালিবাগে এক ডাক্তারের বাসায় কাজ করে। তিন বছর ওই এক বাড়িতেই কাজ করছে। ওরা থাকে মালিবাগের এক চারে। চারগুলো তোলা হয় খালের ওপর। সাঁকোর মতো কাঠের পাটাতনের ওপর টিনের বেড়া দিয়ে বানানো এই চারের একটা ঘরে থাকে ওরা। ভাড়া ১২০০ টাকা। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটাকে একটা চায়ের দোকানে লাগিয়ে দিয়েছে লালমতি । মেয়েটা ছোট। কাজে যাওয়ার সময়, যাতে মেয়েটা নিচে খালের পানিতে পড়ে না যায় সে জন্য খাটের ওপর বসিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যায় মেয়েটাকে । খাটটা ওদের বিয়ের খাট। সব কিছু গেছে। এটাই এখন আগেকার সব স্মৃতি ধরে রেখেছে।
লালমতি কাজে যাওয়ার আগে ছেলে মেয়েকে খাইয়ে নিজেও একটা পাউরুটির দুইটা টুকরা এক কাপ চা’য়ে চুবিয়ে খেয়ে পা মেলে বসে পান মুখে দিচ্ছিলো। স্বামীর কথা শুনে কিছু না বলে চোখ তুলে তাকায়।
আজ মেলা ট্যাকা কামাই হইছে, এই রকমই কামাই করুম। আর না খাইয়া থাকতে হইবো না। তোরেও আর কাম করতে হইবো না। লাল মিয়া বলে।
কয়দিন করবা এই রকম কাম, দেখা যাইবো নে। এখন গোসল দিয়া ভাত খাও। আমার কামে যাওনের সময় হইছে। যখন ট্যাকা কামাই করবা তখন কাম ছাইড়া দিমু নে। এখন যাও। আমার দেরী হইতাছে।
লাল মিয়া আর লালমতির গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। পাশাপাশি বাড়িতে বেড়ে ওঠা ওদের। একসঙ্গে খেলাধূলা করেছে। বছর দুয়েকের ছোট বড়ো দুজনে। লাল মিয়া আর লালমতি দুজনের গায়ের রঙই ফর্সা। ছোটবেলায় ওদের গালে লাল আভা থাকার জন্য ওদের এই নাম রেখেছে ওদের বাবা-মা।
লাল মিয়া গ্রামের বড়ো ঘরের ছেলে। জোতদার না হলেও অভাব ছিলো না লাল মিয়ার বাবার। পরিবারে একটাই ছেলে হওয়ার কারণে ‘আদরে আদরে বাঁদর’ হওয়ায় প্রাইমারী ডিঙানো হয়ে ওঠে নি তার। আর লালমতির তো কথাই নেই। ভাই-বোন মিলে তারা এক ফুটবল টীম। সেখানে সবার ছোট লালমতি। ফুটবল টীমের জন্মদাতা আর জন্মদাত্রীর অজ্ঞানতার ফল ভোগ করতে হচ্ছে লালমতি আর ওর ভাইবোনদের।
লাল মিয়ার বাবা চেয়েছিলো ছেলে লেখাপড়া শিখে জজ-ব্যারিস্টার না হলেও একটা চাকরি করবে। কিন্তু লাল মিয়ার বাবার সে আশা পূরণ হয় নি। লাল মিয়ার পড়ায় মন ছিলো না। স্কুল পালিয়ে, সারাদিন মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে, বনে জঙ্গলে পাখি পেড়ে, এর তার বাঁধা গরু ছাগল ছেড়ে দিয়ে কাটিয়েছে তার শিশুকাল। এসব কাজের সঙ্গী লালমতি। ছোট বেলার পুতুল খেলার সময় খেলাঘরের বর লাল মিয়া। খেলাঘরের মিছিমিছি হাট বাজার করতো লাল মিয়া আর রান্নাবান্না করতো লালমতি। গ্রামের লোকের কেউ বলতো ‘বট পাকুরের জুড়ি’ কেউবা বলতো শিব পার্বতী।
সেই লালমতি, ঋতুমতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের মেলামশা বন্ধ হয়ে যায়। তখন বহির্মুখী লাল মিয়ার কিছু দোস্ত-বন্ধু জুটে যায়, যারা খারাপ নেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলো । ওদের সঙ্গে মিশে লাল মিয়ারও ধরে যায় জুয়া খেলার মতো খারাপ নেশা। অভ্যাস হয় বিড়ি, সিগারেট খাওয়ার। প্রথম দিকে মার্বেল দিয়ে খেলতো। একটু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাসের আড্ডায় যাওয়া শুরু হয়। ঘরের জিনিষপত্র বিক্রি, মহাজনদের টাকার তাগাদায় অস্থির হয়ে ওঠে লাল মিয়ার বাবা। চিন্তা-ভাবনা করে স্থির করে বিয়ে দেওয়ার। মা বলে, বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে হয়ে যায় লালমতির সঙ্গে।
বিয়ের পর কয়েক বছর ভালোই ছিলো। জুয়া খেললেও লাল মিয়ার ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না। লাল মিয়ার ভালোবাসা এতোই ছিলো যে ১৪ বছরের লালমতির কাছে অসহ্য লাগতো। ওর কাছে মনে হতো মানুষটার ভালোবাসা আদর ঠিক ভালোবাসা বা আদর না, ক্ষুধা পেলে খাবার খাওয়ার মতো। ওর খারাপ লাগলেও বলতো না কিছু। বিয়ের দিন, ওর শাশুড়ি ওকে বলেছিলো,
শোন মা, আমার পোলাডারে ভালো করণের জন্যিই কিন্তু তোমারে এই বাড়িতে আনা। ও যা কয়, তা চোখ বন্ধ কইরা শুনবা।
শাশুড়ির কথামতো চলতে চেষ্টা করেছে। লাল মিয়ার কথার বাইরে যায় নি। মনে ভয় যদি কোন অঘটন ঘটে। সব মিলিয়ে দিন ভালোই যাচ্ছিলো। গোল বাধলো শ্বশুর মারা যাওয়ার পর। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর বেড়ে গেলো জুয়ার নেশা। বাড়ি আসাও প্রায় বন্ধ। এক রাত আসে তো তিন রাত আসে না। সব জমি-জমা বিক্রি করে দিয়ে জুয়ায় হেরে শেষে বসত বাড়ি বিক্রি করতে চাইতেই মায়ের সঙ্গে শুরু হলো ঝগড়া, কথা কাটাকাটি। মায়ের হার্ট অ্যাটাক। মারা গেলো মা। মা মারা যেতে হুঁশ হলো ছেলের।
কিন্তু তখন তো তার কাছে কিছুই নেই, না জমি-জিরেত না থাকার ভিটে। অন্যের জমিতে কামলা দেওয়া শুরু করে। তাও একদিন করে তো দুইদিন করে না। ক্ষুধার আগুন জ্বলে জঠরে। সারাক্ষণ খাবার চাই, খাবার চাই। খাওয়ার পেট তো একটা না চারটা। ছোট মেয়েটার বয়স দুই মাস। দুধ চাই। নিজের ক্ষুধা তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু চোখের সামনে ক্ষুধায় ছেলে মেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে লালমতি বলে,
আমি চেয়ারম্যানের বাড়ি কাম করুম।
কথা শুনে লাল মিয়ার মাথায় হাত। নিজের গ্রামে বউরে তো কাম করতে দেওয়া যায় না। একটা ইজ্জত আছে তো তার ! কিন্তু বউ এর সঙ্গে রোজ ঝগড়া, রোজ বউ এর কান্না, রোজকার ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না লাল মিয়ার। শেষে চলে আসে ঢাকা শহরের এই বস্তিতে।
লালমতির এই মুহূর্তে কাজ বাদ দিতে না চাওয়ায় রাগ করে না লাল মিয়া। আবারও সেই ভাষণ দেওয়ার মতো করেই কথা বলে লাল মিয়া।
না পরে না, আজ থাইক্কাই কাম বাদ দিতে হইবো, কাম বাদ দিবি কি, দিবি না ক’ ?
পান মুখে দিয়ে চিবুচ্ছিলো লালমতি। পানের পিচকি পিচ করে পাটাতনের ফাঁক দিয়ে ফেলে বলে,
ঠিকই আছে, কইতাছ যখন তখন ছাইড়া দিমু। বউরে খাওন-পরন দেওনের দায়িত্ব তো স্বামীর।
হাসে লালমতি। ওর হাসিতে বিরক্ত হয় লাল মিয়া। বলে,
হাসিস না, লালমতি, হাসির কথা কই নাই। তুই কী ভাবছস, আমি তোরে খুশী করার জন্য এই কথা কইতাছি , তা না। তুই কী মনে করছস, ভাত কাপড় দিয়া খুশী রাখতে পারুম না তোরে, পারুম রে, পারুম। ঠিকই পারুম । আমি ঠিক করছি, আর জুয়া খেলুম না। জুয়া খেলা খুব খারাপ কাম।
স্বামী জুয়া খেলবে না শুনে খুব খুশী হয় লালমতি। খুশীতে চিকচিক করে ওর দুটি চোখ। আদর আর আবেগে থরথর কাঁপে লালমতির কণ্ঠ। বলে,
সত্য কইতাছ, আর খেলবা না ! রোজ কাম করবা !
হ, হ, ঠিক কইতাছি। বিশ্বাস রাখ।
লালমতি সমস্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
ঠিক আছে, আমি কাম ছাইড়া দিলাম। এখন থাইক্কা পোলাডারেও আর কাম করতে দিমু না। ওরে ইস্কুলে দিমু। লেখাপড়া করামু। আমরা আবার আগের মতো থাকুম।
ঠিক কইছস বউ। আমি তো লেখাপড়া না কইরা ভাদাইম্মা হইছি, কাসেম রে আর ভাদাইম্মা হইতে দিমু না।
লাল মিয়ার দুই চোখ অপত্য স্নেহে ভিজে ওঠে। ছেলে, মেয়ে, বউ এর জন্য বুকের ভেতর খেলা করে আবেগ মথিত ভালোবাসা।
লালমতি ছেড়ে দেয় কাজ। লাল মিয়া আর খেলে না জুয়া। রোজ রিকশা নিয়ে বের হয়। কাজ শেষে ঘরে ফিরে সময় কাটায় বউ, ছেলে মেয়ের সঙ্গে। কোন কোন দিন রিকশায় ওদের নিয়ে বেড়াতে যায়।
লালমতি রান্না করে, স্বামী, ছেলে মেয়ের যত্ন করে। লাল মিয়ার কিনে দেওয়া শাড়ি, চুড়ি কসমেটিকস দিয়ে সাজুগুজু করে। আনন্দে ওর মনের আকাশে উড়ে বেড়ায় বালিহাঁসের ঝাঁক।
এমন করে হাসি আনন্দে কেটে যায় একটি বছর। লাল মিয়া এখন পাঁচটা রিকশার মালিক। ও নিজে একটা চালায় আর চারটা ভাড়া দেয়। একদিন লাল মিয়া এসে বলে,
ও বউ জিনিষপাতি সব বাইন্ধা নে, আমরা এ ঘর ছাইড়া দিমু। নতুন চারে নতুন ঘরে যামু।
নতুন চার, নতুন ঘর! বিস্মিত লালমতি। কোনখানে ?
ওই তো ওই খানে। সেদিন যে তোরে দেখাইয়া আনলাম। পাঁচটা ঘর লইয়া ওই চারটা কিনছি। অর্ধেক দাম দিছি, আর অর্ধেক ছয় মাস পরে দিলেই হইবো। পাঁচটা ঘরের, দুইটাতে থাকুম আর তিনটা ভাড়া দিমু।
এতো টাকা কই পাইলা? বলে লালমতি। লাল মিয়া বলে,
টাকার চিন্তা তোর না। তুই ওঠ। আরও শুইনা রাখ, পুনর্বাসন প্রকল্পে যে ফ্ল্যাট দিতাছে তাও কিনবার চেষ্টা চালাইতেছি।
ফিলাট কিনবা? অ্যাত্তো ট্যাকা কই পাইবা? আবার কোন কুকাম করতাছ না তো ? লালমতি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
ওঠ তো ওঠ। বেলা নাই, ওঠ। লাল মিয়া তাড়া দেয়।
লালমতি ছেলে মেয়েকে কাপড় পরিয়ে নিজেও সাজুগুজু করে তৈরি হয়। রিকশায় ওদের বসিয়ে নতুন চারের পথে রিকশা চালাতে থাকে লাল মিয়া। কথা বলে লালমতির সঙ্গে, ছেলে মেয়ের সঙ্গে। কথায় পেয়ে বসে লাল মিয়াকে।
তোরে নিয়া যে আমার অনেক আহ্লাদ আছে রে বউ, তুই জানোস না। তোরে এখন কেবলই সাজাইয়া রাখুম ঘরে। তুই সাজুগুজু করবি, পান খাবি আর বইয়া থাকবি। কোন কাম করবি না। পোলা-মাইয়া দেখন ছাড়া আর কোন কাম নাই তোর, বুঝলি।
স্বামীর কথায় হাসে লালমতি। বাতাসে ছড়ায় ওর হাসি। বাতাসে ওড়ে ওর লাল শাড়ির আঁচল।
লাল মিয়া গান ধরে- ‘ ঢাকা শহর দেখামু তরে ঘুইরা ঘুইরা’। রিকশার চাকা ঘোরে আর লাল মিয়ার মনের সৈকতে আগামি দিনের ভালবাসার সফেদ ঢেউ ভাঙে। লাল মিয়া ভাবে, আগে যতো কষ্ট লালমতিকে দিয়েছে, সব, সব কষ্ট সুদে-আসলে পুষিয়ে দিবে। অনেক অনেক আদর করবে লালমতিকে। লালমতি কোনদিন, কোন অনুযোগ করতে পারে এমন কোন সুযোগই আর দিবে না ওকে। লালমতিকে নিয়ে ভাবনার সঙ্গে ভালোবাসার সব রঙ নিয়ে এক সুন্দর সুখময় পাখির জন্ম হয় লাল মিয়ার বুকের ভেতর।
রিকশা চলছে। হঠাৎ ধাক্কা, উল্টে যায় রিকশা। রিকশায় পা-দানীতে আটকিয়ে যায় চালকের পা, আর ছিটকে যায় আরোহিরা। রিকশার নিচে চাপা পড়ে চালক। শোঁ শাঁ নাগালের বাইরে চলে যায় বাস। বাস যাওয়ার সঙ্গে বোম ব্লাস্টের মতো আওয়াজ হয়। দেখতে দেখতে মানুষ জমে যায় ওদের চারপাশে। কয়েকজন মিলে রিকশার ভেতর থেকে টেনে বের করে লাল মিয়াকে। লাল মিয়া ছেলে মেয়ের খোঁজ করে, পেয়েও যায়। কিন্তু লালমতি কোথায় ? লাল মিয়া ডাকে,
লালমতি, এই লালমতি, কই তুই? বউ রে, কই তুই ?
কিন্তু কে দিবে লাল মিয়ার ডাকে সাড়া। যে সাড়া দিবে, সে তো বাসের চাকায় পিষ্ট নিথর পড়ে আছে রাস্তায়। মাথা, মুখ থেতলে গিয়েছে। মাথার মগজ ছিটকে পড়েছে কয়েক হাত দূরে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে জমাট বাঁধছে লালমতির লাল আঁচলে।
পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় লাল মিয়া। তারপর বুকভাঙা স্বরে লালমতিরে--- ডেকেই লালমতির বুকের ওপর আছড়ে পড়ে। কয়েকজন মিলে সরিয়ে আনে ওকে। লাল মিয়া উঠতে চায় না। ওর বুকের ভেতর ছটফট করে ভালোবাসার সেই রঙিলা পাখি। লালমতিকে বুকের গভীরে জড়িয়ে ধরতে চায় সেই পাখি। অনেক অনেক আদর দিতে চায় লালমতিকে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না, করা হয় না ওর। শুধু স্বপ্নভাঙা এক উদাস শূণ্য বেদনায় ভালোবাসার অমলিন ক্ষুধা তড়পাতে থাকে লাল মিয়ার বুকের ভেতরে। ওর বুকের ভেতরের এই ক্ষুধা, এই ছটফটানি টের পায় না দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো।
শবেবরাতের সারা রাত রিকশা চালিয়ে ঘরে ফিরে চোঙা মুখে ‘স্কুলের মাঠে জনসভা, জনসভায় যোগ দিন, যোগ দিন’ জাতীয় চোঙা ফোকার মতো করে কথাগুলো বলে যায় লাল মিয়া।
লাল মিয়া রিকশা চালায়। লালমিয়ার বউ, লালমতি মালিবাগে এক ডাক্তারের বাসায় কাজ করে। তিন বছর ওই এক বাড়িতেই কাজ করছে। ওরা থাকে মালিবাগের এক চারে। চারগুলো তোলা হয় খালের ওপর। সাঁকোর মতো কাঠের পাটাতনের ওপর টিনের বেড়া দিয়ে বানানো এই চারের একটা ঘরে থাকে ওরা। ভাড়া ১২০০ টাকা। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটাকে একটা চায়ের দোকানে লাগিয়ে দিয়েছে লালমতি । মেয়েটা ছোট। কাজে যাওয়ার সময়, যাতে মেয়েটা নিচে খালের পানিতে পড়ে না যায় সে জন্য খাটের ওপর বসিয়ে খাটের পায়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যায় মেয়েটাকে । খাটটা ওদের বিয়ের খাট। সব কিছু গেছে। এটাই এখন আগেকার সব স্মৃতি ধরে রেখেছে।
লালমতি কাজে যাওয়ার আগে ছেলে মেয়েকে খাইয়ে নিজেও একটা পাউরুটির দুইটা টুকরা এক কাপ চা’য়ে চুবিয়ে খেয়ে পা মেলে বসে পান মুখে দিচ্ছিলো। স্বামীর কথা শুনে কিছু না বলে চোখ তুলে তাকায়।
আজ মেলা ট্যাকা কামাই হইছে, এই রকমই কামাই করুম। আর না খাইয়া থাকতে হইবো না। তোরেও আর কাম করতে হইবো না। লাল মিয়া বলে।
কয়দিন করবা এই রকম কাম, দেখা যাইবো নে। এখন গোসল দিয়া ভাত খাও। আমার কামে যাওনের সময় হইছে। যখন ট্যাকা কামাই করবা তখন কাম ছাইড়া দিমু নে। এখন যাও। আমার দেরী হইতাছে।
লাল মিয়া আর লালমতির গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। পাশাপাশি বাড়িতে বেড়ে ওঠা ওদের। একসঙ্গে খেলাধূলা করেছে। বছর দুয়েকের ছোট বড়ো দুজনে। লাল মিয়া আর লালমতি দুজনের গায়ের রঙই ফর্সা। ছোটবেলায় ওদের গালে লাল আভা থাকার জন্য ওদের এই নাম রেখেছে ওদের বাবা-মা।
লাল মিয়া গ্রামের বড়ো ঘরের ছেলে। জোতদার না হলেও অভাব ছিলো না লাল মিয়ার বাবার। পরিবারে একটাই ছেলে হওয়ার কারণে ‘আদরে আদরে বাঁদর’ হওয়ায় প্রাইমারী ডিঙানো হয়ে ওঠে নি তার। আর লালমতির তো কথাই নেই। ভাই-বোন মিলে তারা এক ফুটবল টীম। সেখানে সবার ছোট লালমতি। ফুটবল টীমের জন্মদাতা আর জন্মদাত্রীর অজ্ঞানতার ফল ভোগ করতে হচ্ছে লালমতি আর ওর ভাইবোনদের।
লাল মিয়ার বাবা চেয়েছিলো ছেলে লেখাপড়া শিখে জজ-ব্যারিস্টার না হলেও একটা চাকরি করবে। কিন্তু লাল মিয়ার বাবার সে আশা পূরণ হয় নি। লাল মিয়ার পড়ায় মন ছিলো না। স্কুল পালিয়ে, সারাদিন মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে, বনে জঙ্গলে পাখি পেড়ে, এর তার বাঁধা গরু ছাগল ছেড়ে দিয়ে কাটিয়েছে তার শিশুকাল। এসব কাজের সঙ্গী লালমতি। ছোট বেলার পুতুল খেলার সময় খেলাঘরের বর লাল মিয়া। খেলাঘরের মিছিমিছি হাট বাজার করতো লাল মিয়া আর রান্নাবান্না করতো লালমতি। গ্রামের লোকের কেউ বলতো ‘বট পাকুরের জুড়ি’ কেউবা বলতো শিব পার্বতী।
সেই লালমতি, ঋতুমতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের মেলামশা বন্ধ হয়ে যায়। তখন বহির্মুখী লাল মিয়ার কিছু দোস্ত-বন্ধু জুটে যায়, যারা খারাপ নেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলো । ওদের সঙ্গে মিশে লাল মিয়ারও ধরে যায় জুয়া খেলার মতো খারাপ নেশা। অভ্যাস হয় বিড়ি, সিগারেট খাওয়ার। প্রথম দিকে মার্বেল দিয়ে খেলতো। একটু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাসের আড্ডায় যাওয়া শুরু হয়। ঘরের জিনিষপত্র বিক্রি, মহাজনদের টাকার তাগাদায় অস্থির হয়ে ওঠে লাল মিয়ার বাবা। চিন্তা-ভাবনা করে স্থির করে বিয়ে দেওয়ার। মা বলে, বিয়ে দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ে হয়ে যায় লালমতির সঙ্গে।
বিয়ের পর কয়েক বছর ভালোই ছিলো। জুয়া খেললেও লাল মিয়ার ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না। লাল মিয়ার ভালোবাসা এতোই ছিলো যে ১৪ বছরের লালমতির কাছে অসহ্য লাগতো। ওর কাছে মনে হতো মানুষটার ভালোবাসা আদর ঠিক ভালোবাসা বা আদর না, ক্ষুধা পেলে খাবার খাওয়ার মতো। ওর খারাপ লাগলেও বলতো না কিছু। বিয়ের দিন, ওর শাশুড়ি ওকে বলেছিলো,
শোন মা, আমার পোলাডারে ভালো করণের জন্যিই কিন্তু তোমারে এই বাড়িতে আনা। ও যা কয়, তা চোখ বন্ধ কইরা শুনবা।
শাশুড়ির কথামতো চলতে চেষ্টা করেছে। লাল মিয়ার কথার বাইরে যায় নি। মনে ভয় যদি কোন অঘটন ঘটে। সব মিলিয়ে দিন ভালোই যাচ্ছিলো। গোল বাধলো শ্বশুর মারা যাওয়ার পর। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর বেড়ে গেলো জুয়ার নেশা। বাড়ি আসাও প্রায় বন্ধ। এক রাত আসে তো তিন রাত আসে না। সব জমি-জমা বিক্রি করে দিয়ে জুয়ায় হেরে শেষে বসত বাড়ি বিক্রি করতে চাইতেই মায়ের সঙ্গে শুরু হলো ঝগড়া, কথা কাটাকাটি। মায়ের হার্ট অ্যাটাক। মারা গেলো মা। মা মারা যেতে হুঁশ হলো ছেলের।
কিন্তু তখন তো তার কাছে কিছুই নেই, না জমি-জিরেত না থাকার ভিটে। অন্যের জমিতে কামলা দেওয়া শুরু করে। তাও একদিন করে তো দুইদিন করে না। ক্ষুধার আগুন জ্বলে জঠরে। সারাক্ষণ খাবার চাই, খাবার চাই। খাওয়ার পেট তো একটা না চারটা। ছোট মেয়েটার বয়স দুই মাস। দুধ চাই। নিজের ক্ষুধা তাও সহ্য করা যায়, কিন্তু চোখের সামনে ক্ষুধায় ছেলে মেয়ের কান্না সহ্য করতে না পেরে লালমতি বলে,
আমি চেয়ারম্যানের বাড়ি কাম করুম।
কথা শুনে লাল মিয়ার মাথায় হাত। নিজের গ্রামে বউরে তো কাম করতে দেওয়া যায় না। একটা ইজ্জত আছে তো তার ! কিন্তু বউ এর সঙ্গে রোজ ঝগড়া, রোজ বউ এর কান্না, রোজকার ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না লাল মিয়ার। শেষে চলে আসে ঢাকা শহরের এই বস্তিতে।
লালমতির এই মুহূর্তে কাজ বাদ দিতে না চাওয়ায় রাগ করে না লাল মিয়া। আবারও সেই ভাষণ দেওয়ার মতো করেই কথা বলে লাল মিয়া।
না পরে না, আজ থাইক্কাই কাম বাদ দিতে হইবো, কাম বাদ দিবি কি, দিবি না ক’ ?
পান মুখে দিয়ে চিবুচ্ছিলো লালমতি। পানের পিচকি পিচ করে পাটাতনের ফাঁক দিয়ে ফেলে বলে,
ঠিকই আছে, কইতাছ যখন তখন ছাইড়া দিমু। বউরে খাওন-পরন দেওনের দায়িত্ব তো স্বামীর।
হাসে লালমতি। ওর হাসিতে বিরক্ত হয় লাল মিয়া। বলে,
হাসিস না, লালমতি, হাসির কথা কই নাই। তুই কী ভাবছস, আমি তোরে খুশী করার জন্য এই কথা কইতাছি , তা না। তুই কী মনে করছস, ভাত কাপড় দিয়া খুশী রাখতে পারুম না তোরে, পারুম রে, পারুম। ঠিকই পারুম । আমি ঠিক করছি, আর জুয়া খেলুম না। জুয়া খেলা খুব খারাপ কাম।
স্বামী জুয়া খেলবে না শুনে খুব খুশী হয় লালমতি। খুশীতে চিকচিক করে ওর দুটি চোখ। আদর আর আবেগে থরথর কাঁপে লালমতির কণ্ঠ। বলে,
সত্য কইতাছ, আর খেলবা না ! রোজ কাম করবা !
হ, হ, ঠিক কইতাছি। বিশ্বাস রাখ।
লালমতি সমস্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
ঠিক আছে, আমি কাম ছাইড়া দিলাম। এখন থাইক্কা পোলাডারেও আর কাম করতে দিমু না। ওরে ইস্কুলে দিমু। লেখাপড়া করামু। আমরা আবার আগের মতো থাকুম।
ঠিক কইছস বউ। আমি তো লেখাপড়া না কইরা ভাদাইম্মা হইছি, কাসেম রে আর ভাদাইম্মা হইতে দিমু না।
লাল মিয়ার দুই চোখ অপত্য স্নেহে ভিজে ওঠে। ছেলে, মেয়ে, বউ এর জন্য বুকের ভেতর খেলা করে আবেগ মথিত ভালোবাসা।
লালমতি ছেড়ে দেয় কাজ। লাল মিয়া আর খেলে না জুয়া। রোজ রিকশা নিয়ে বের হয়। কাজ শেষে ঘরে ফিরে সময় কাটায় বউ, ছেলে মেয়ের সঙ্গে। কোন কোন দিন রিকশায় ওদের নিয়ে বেড়াতে যায়।
লালমতি রান্না করে, স্বামী, ছেলে মেয়ের যত্ন করে। লাল মিয়ার কিনে দেওয়া শাড়ি, চুড়ি কসমেটিকস দিয়ে সাজুগুজু করে। আনন্দে ওর মনের আকাশে উড়ে বেড়ায় বালিহাঁসের ঝাঁক।
এমন করে হাসি আনন্দে কেটে যায় একটি বছর। লাল মিয়া এখন পাঁচটা রিকশার মালিক। ও নিজে একটা চালায় আর চারটা ভাড়া দেয়। একদিন লাল মিয়া এসে বলে,
ও বউ জিনিষপাতি সব বাইন্ধা নে, আমরা এ ঘর ছাইড়া দিমু। নতুন চারে নতুন ঘরে যামু।
নতুন চার, নতুন ঘর! বিস্মিত লালমতি। কোনখানে ?
ওই তো ওই খানে। সেদিন যে তোরে দেখাইয়া আনলাম। পাঁচটা ঘর লইয়া ওই চারটা কিনছি। অর্ধেক দাম দিছি, আর অর্ধেক ছয় মাস পরে দিলেই হইবো। পাঁচটা ঘরের, দুইটাতে থাকুম আর তিনটা ভাড়া দিমু।
এতো টাকা কই পাইলা? বলে লালমতি। লাল মিয়া বলে,
টাকার চিন্তা তোর না। তুই ওঠ। আরও শুইনা রাখ, পুনর্বাসন প্রকল্পে যে ফ্ল্যাট দিতাছে তাও কিনবার চেষ্টা চালাইতেছি।
ফিলাট কিনবা? অ্যাত্তো ট্যাকা কই পাইবা? আবার কোন কুকাম করতাছ না তো ? লালমতি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।
ওঠ তো ওঠ। বেলা নাই, ওঠ। লাল মিয়া তাড়া দেয়।
লালমতি ছেলে মেয়েকে কাপড় পরিয়ে নিজেও সাজুগুজু করে তৈরি হয়। রিকশায় ওদের বসিয়ে নতুন চারের পথে রিকশা চালাতে থাকে লাল মিয়া। কথা বলে লালমতির সঙ্গে, ছেলে মেয়ের সঙ্গে। কথায় পেয়ে বসে লাল মিয়াকে।
তোরে নিয়া যে আমার অনেক আহ্লাদ আছে রে বউ, তুই জানোস না। তোরে এখন কেবলই সাজাইয়া রাখুম ঘরে। তুই সাজুগুজু করবি, পান খাবি আর বইয়া থাকবি। কোন কাম করবি না। পোলা-মাইয়া দেখন ছাড়া আর কোন কাম নাই তোর, বুঝলি।
স্বামীর কথায় হাসে লালমতি। বাতাসে ছড়ায় ওর হাসি। বাতাসে ওড়ে ওর লাল শাড়ির আঁচল।
লাল মিয়া গান ধরে- ‘ ঢাকা শহর দেখামু তরে ঘুইরা ঘুইরা’। রিকশার চাকা ঘোরে আর লাল মিয়ার মনের সৈকতে আগামি দিনের ভালবাসার সফেদ ঢেউ ভাঙে। লাল মিয়া ভাবে, আগে যতো কষ্ট লালমতিকে দিয়েছে, সব, সব কষ্ট সুদে-আসলে পুষিয়ে দিবে। অনেক অনেক আদর করবে লালমতিকে। লালমতি কোনদিন, কোন অনুযোগ করতে পারে এমন কোন সুযোগই আর দিবে না ওকে। লালমতিকে নিয়ে ভাবনার সঙ্গে ভালোবাসার সব রঙ নিয়ে এক সুন্দর সুখময় পাখির জন্ম হয় লাল মিয়ার বুকের ভেতর।
রিকশা চলছে। হঠাৎ ধাক্কা, উল্টে যায় রিকশা। রিকশায় পা-দানীতে আটকিয়ে যায় চালকের পা, আর ছিটকে যায় আরোহিরা। রিকশার নিচে চাপা পড়ে চালক। শোঁ শাঁ নাগালের বাইরে চলে যায় বাস। বাস যাওয়ার সঙ্গে বোম ব্লাস্টের মতো আওয়াজ হয়। দেখতে দেখতে মানুষ জমে যায় ওদের চারপাশে। কয়েকজন মিলে রিকশার ভেতর থেকে টেনে বের করে লাল মিয়াকে। লাল মিয়া ছেলে মেয়ের খোঁজ করে, পেয়েও যায়। কিন্তু লালমতি কোথায় ? লাল মিয়া ডাকে,
লালমতি, এই লালমতি, কই তুই? বউ রে, কই তুই ?
কিন্তু কে দিবে লাল মিয়ার ডাকে সাড়া। যে সাড়া দিবে, সে তো বাসের চাকায় পিষ্ট নিথর পড়ে আছে রাস্তায়। মাথা, মুখ থেতলে গিয়েছে। মাথার মগজ ছিটকে পড়েছে কয়েক হাত দূরে। রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে জমাট বাঁধছে লালমতির লাল আঁচলে।
পায়ে পায়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায় লাল মিয়া। তারপর বুকভাঙা স্বরে লালমতিরে--- ডেকেই লালমতির বুকের ওপর আছড়ে পড়ে। কয়েকজন মিলে সরিয়ে আনে ওকে। লাল মিয়া উঠতে চায় না। ওর বুকের ভেতর ছটফট করে ভালোবাসার সেই রঙিলা পাখি। লালমতিকে বুকের গভীরে জড়িয়ে ধরতে চায় সেই পাখি। অনেক অনেক আদর দিতে চায় লালমতিকে। কিন্তু কিছুই করতে পারে না, করা হয় না ওর। শুধু স্বপ্নভাঙা এক উদাস শূণ্য বেদনায় ভালোবাসার অমলিন ক্ষুধা তড়পাতে থাকে লাল মিয়ার বুকের ভেতরে। ওর বুকের ভেতরের এই ক্ষুধা, এই ছটফটানি টের পায় না দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো।
Md. Mamunur Rashid
এক লোকের চারজন স্ত্রী ছিল । লোকটা তার
৪র্থ স্ত্রীকেই বেশী ভালোবাসতো এবং যত্ন
করতো ।
সে তার ৩য় স্ত্রীকেও অনেক
ভালোবাসতো এবং বন্ধু বান্ধবদের সামনে স্ত্রীর
প্রশংসা করতো । তার ভয় ছিলো যে এই স্ত্রী হয়তো কোনদিন অন্য
কারো সাথে পালিয়ে যেতে পারে !
সে তার ২য় স্ত্রীকেও ভালোবাসতো ।
লোকটা যখনি কোন বিপদে পড়তো ,
তখনি সে তার এই স্ত্রীর কাছে সমাধান
চাইতো এবং তার স্ত্রী তাকে সমাধান দিয়ে সাহায্য করতো ।
কিন্তু লোকটা তার ১ম স্ত্রীকে একদম
ভালোবাসতো না এবং যত্নও করতোনা । এই
স্ত্রী লোকটাকে অত্যন্ত ভালোবাসতো , তার
অনুগত থাকতো এবং তার যত্ন নিতে চাইতো ।
লোকটা তা পছন্দ করতোনা । একদিন লোকটা অসুস্থ
হয়ে পড়লো এবং জানতে পারলো যে সে আর
বেশীদিন বাঁচবেনা ।
লোকটা ইচ্ছা করলো যে সে যখন মারা যাবে ,
তার কোন একটা স্ত্রীকেও নিয়ে যাবে তার
সাথে করে , যাতে করে সে শান্তি পেতে পারে এই
ভেবে যে মৃত্যুর পর সে একা নয় , তার একজন
সঙ্গীও সাথে আছে ।
লোকটা তিনজন স্ত্রীকে ডেকে এনে তার
সাথে মৃত্যুবরণ করার
ইচ্ছাটা বললো এবং কে যেতে চায় তা জিজ্ঞেস করলো ।
"এটা হতেই পারেনা ।" বলেই তার ৪র্থ
স্ত্রী সাথে সাথে ঐ
জায়গা থেকে চলে গেলো লোকটার
ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান করে ।
৩য় স্ত্রী বললো, "জীবন এখানে খুবই সুন্দর । তোমার মৃত্যুর পর আমি অন্য
কাউকে বিয়ে করে নিবো ।" বলে সেও চলে গেল
।
২য় স্ত্রী বললো, "তুমি আমার কাছে সমাধান
চাইতে । কিন্তু এই ব্যাপারে আমার কোন সমাধান
নেই । দুঃখিত তোমাকে সাহায্য করতে না পেরে । তবে তোমার মৃত্যুর আগ
পর্যন্ত আমি তোমার পাশে সর্বদা আছি ।"
স্ত্রীদের কথা শুনে লোকটা অত্যন্ত কষ্ট
পেলো এবং বিমর্ষ হয়ে পড়লো ।
"আমি তোমার সাথে যাব , তুমি যেখানেই
যাওনা কেন , আমি তোমাকে অনুসরণ করবো ।" হঠাত্ একটা কন্ঠ বলে উঠলো !
লোকটা তাকিয়ে দেখলো যে কন্ঠটা তার ১ম
স্ত্রীর । ভালোবাসা এবং যত্নের অভাবে তার এই
স্ত্রীর চেহারা মলিন , দেহ কঙ্কালসার ,
অপুষ্টির চিহ্ন সারা শরীরে । লোকটা অশ্রুসিক্ত
নয়নে বললো , "হায় কি আফসোস ! তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি , যত্ন করিনি ।
আজ তুমি আমার সাথে যেতে চাইছ । এতদিন
কি ভুলটাই না করেছি তোমার কথা না ভেবে !
আজ শেষ সময়ে ভুলটা বুঝতে পারলাম !"
আসলে , আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই চারজন
স্ত্রীর মত ব্যাপারটি আছে । ১) ৪র্থ স্ত্রী হচ্ছে আমাদের শরীর । জীবনের
বেশীর ভাগ সময় এবং অর্থ আমরা এটির
পিছনে ব্যয় করি । কিন্তু মৃত্যু এলেই
এটি আমাদেরকে ফেলে চলে যায় ।
২) ৩য় স্ত্রী হচ্ছে আমাদের ধন সম্পত্তি ,
টাকা পয়সা , সুনাম এবং মালিকানা , যা আমরা অন্যদের দেখিয়ে বেড়াই । মৃত্যুর পর
এগুলো অন্যদের কাছে চলে যায় ।
৩) ২য় স্ত্রী হচ্ছে আমাদের পরিবার
এবং বন্ধুবান্ধব ।
এরা আমাদেরকে নানা বিপদে আপদে সাহায্য
করে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের পাশে থাকে ।
৪) আর ১ম স্ত্রী হচ্ছে আমাদের আত্না ।
পার্থিব সুখ শান্তি আনন্দ এবং সম্পদের
পিছে ছুটতে ছুটতে আমরা আত্নার কথা ভুলে যাই
। আত্নার খোরাক মেটাতে পারিনা । যত্ন
নিতে পারিনা । ভালোবাসিনা । কিন্তু এটিই একমাত্র জিনিস যা আমাদের
প্রত্যেকটা কাজে আমাদের অনুসরণ করে ।
যেখানেই যাই আমাদের পাশে থাকে এবং মৃত্যুর
পরেও পারলৌকিক
জীবনে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে ।
৪র্থ স্ত্রীকেই বেশী ভালোবাসতো এবং যত্ন
করতো ।
সে তার ৩য় স্ত্রীকেও অনেক
ভালোবাসতো এবং বন্ধু বান্ধবদের সামনে স্ত্রীর
প্রশংসা করতো । তার ভয় ছিলো যে এই স্ত্রী হয়তো কোনদিন অন্য
কারো সাথে পালিয়ে যেতে পারে !
সে তার ২য় স্ত্রীকেও ভালোবাসতো ।
লোকটা যখনি কোন বিপদে পড়তো ,
তখনি সে তার এই স্ত্রীর কাছে সমাধান
চাইতো এবং তার স্ত্রী তাকে সমাধান দিয়ে সাহায্য করতো ।
কিন্তু লোকটা তার ১ম স্ত্রীকে একদম
ভালোবাসতো না এবং যত্নও করতোনা । এই
স্ত্রী লোকটাকে অত্যন্ত ভালোবাসতো , তার
অনুগত থাকতো এবং তার যত্ন নিতে চাইতো ।
লোকটা তা পছন্দ করতোনা । একদিন লোকটা অসুস্থ
হয়ে পড়লো এবং জানতে পারলো যে সে আর
বেশীদিন বাঁচবেনা ।
লোকটা ইচ্ছা করলো যে সে যখন মারা যাবে ,
তার কোন একটা স্ত্রীকেও নিয়ে যাবে তার
সাথে করে , যাতে করে সে শান্তি পেতে পারে এই
ভেবে যে মৃত্যুর পর সে একা নয় , তার একজন
সঙ্গীও সাথে আছে ।
লোকটা তিনজন স্ত্রীকে ডেকে এনে তার
সাথে মৃত্যুবরণ করার
ইচ্ছাটা বললো এবং কে যেতে চায় তা জিজ্ঞেস করলো ।
"এটা হতেই পারেনা ।" বলেই তার ৪র্থ
স্ত্রী সাথে সাথে ঐ
জায়গা থেকে চলে গেলো লোকটার
ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান করে ।
৩য় স্ত্রী বললো, "জীবন এখানে খুবই সুন্দর । তোমার মৃত্যুর পর আমি অন্য
কাউকে বিয়ে করে নিবো ।" বলে সেও চলে গেল
।
২য় স্ত্রী বললো, "তুমি আমার কাছে সমাধান
চাইতে । কিন্তু এই ব্যাপারে আমার কোন সমাধান
নেই । দুঃখিত তোমাকে সাহায্য করতে না পেরে । তবে তোমার মৃত্যুর আগ
পর্যন্ত আমি তোমার পাশে সর্বদা আছি ।"
স্ত্রীদের কথা শুনে লোকটা অত্যন্ত কষ্ট
পেলো এবং বিমর্ষ হয়ে পড়লো ।
"আমি তোমার সাথে যাব , তুমি যেখানেই
যাওনা কেন , আমি তোমাকে অনুসরণ করবো ।" হঠাত্ একটা কন্ঠ বলে উঠলো !
লোকটা তাকিয়ে দেখলো যে কন্ঠটা তার ১ম
স্ত্রীর । ভালোবাসা এবং যত্নের অভাবে তার এই
স্ত্রীর চেহারা মলিন , দেহ কঙ্কালসার ,
অপুষ্টির চিহ্ন সারা শরীরে । লোকটা অশ্রুসিক্ত
নয়নে বললো , "হায় কি আফসোস ! তোমাকে কখনো ভালোবাসিনি , যত্ন করিনি ।
আজ তুমি আমার সাথে যেতে চাইছ । এতদিন
কি ভুলটাই না করেছি তোমার কথা না ভেবে !
আজ শেষ সময়ে ভুলটা বুঝতে পারলাম !"
আসলে , আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই চারজন
স্ত্রীর মত ব্যাপারটি আছে । ১) ৪র্থ স্ত্রী হচ্ছে আমাদের শরীর । জীবনের
বেশীর ভাগ সময় এবং অর্থ আমরা এটির
পিছনে ব্যয় করি । কিন্তু মৃত্যু এলেই
এটি আমাদেরকে ফেলে চলে যায় ।
২) ৩য় স্ত্রী হচ্ছে আমাদের ধন সম্পত্তি ,
টাকা পয়সা , সুনাম এবং মালিকানা , যা আমরা অন্যদের দেখিয়ে বেড়াই । মৃত্যুর পর
এগুলো অন্যদের কাছে চলে যায় ।
৩) ২য় স্ত্রী হচ্ছে আমাদের পরিবার
এবং বন্ধুবান্ধব ।
এরা আমাদেরকে নানা বিপদে আপদে সাহায্য
করে এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের পাশে থাকে ।
৪) আর ১ম স্ত্রী হচ্ছে আমাদের আত্না ।
পার্থিব সুখ শান্তি আনন্দ এবং সম্পদের
পিছে ছুটতে ছুটতে আমরা আত্নার কথা ভুলে যাই
। আত্নার খোরাক মেটাতে পারিনা । যত্ন
নিতে পারিনা । ভালোবাসিনা । কিন্তু এটিই একমাত্র জিনিস যা আমাদের
প্রত্যেকটা কাজে আমাদের অনুসরণ করে ।
যেখানেই যাই আমাদের পাশে থাকে এবং মৃত্যুর
পরেও পারলৌকিক
জীবনে আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে ।